Brindaban Chandra Math | বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ, গুপ্তিপাড়া, হুগলি


 বৃন্দাবনচন্দ্রের  মঠ,  গুপ্তিপাড়া,  হুগলি

*দিবাকার দেবনাথ*
 
হুগলী জেলার অধীনে গুপ্তিপাড়া পূর্বপ্রান্তে গঙ্গার ধারে রয়েছে “গুপ্ত বৃন্দাবন” যা সেখান কার সাধারণ মানুষের কাছে শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ-মন্দির নামে পরিচিত। পাঁচিল  দিয়ে  ঘেরা  প্রাঙ্গণের  উত্তরের  অংশে  চারটি  মন্দির । তবে এই মঠ চত্বরটিতে কেবলমাত্র শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরই নয়, রয়েছে আরও তিনটি মন্দির  , শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দির, শ্রী রামচন্দ্র মন্দির এবং শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। এই চারটি মন্দির মিলে একত্রে গুপ্তিপাড়ার মঠ।
 

 

বৃন্দাবনচন্দ্রের  মঠ



বৃন্দাবনচন্দ্রের  মঠ

কৃষ্ণচন্দ্রের  মন্দির 

 
 উঁচু  ভিত্তি  বেদির  উপর  স্থাপিত,  ত্রিখিলানবিশিষ্ট,  পূর্বমুখী,  বাংলা  আটচালা  রীতিতে নির্মিত  মন্দির। এই মন্দিরটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১৮০০ শতকের মধ্যভাগ |  সামনের  দিকে  তিনটি  প্রবেশদ্বার।  অলিন্দের  সামনে  একটি  বড়,  দুপাশে  দুটি  ছোট-ছোট।  দক্ষিণ  ও  উত্তর  দিকে  একটি  করে  প্রবেশদ্বার  আছে।  মন্দিরটির  টেরাকোটার  কাজ  অল্প।  সামনের  দিকের  দেওয়ালের  খিলানগুলির  উপরে,  বাঁকানো  কার্নিসের  নিচে  ও  দেওয়ালের  দুধারে  টেরাকোটার  বেশির  ভাগই   ফুল।  অলিন্দের  মধ্যের  'টেরাকোটা'  কলিচুনের  প্রলেপে  অনেকটাই  ম্লান।  মন্দিরের  শীর্ষে  তিনটি  আমলক  স্তুপিকা।  গর্ভগৃহে  শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র  ও  শ্রীরাধিকা  অধিষ্ঠিত ।


 
 মন্দিরটি  নির্মাণ  করেন  দণ্ডি  মধুসূদন। প্রবাদ,  শান্তিপুরের  মধ্যম  গোস্বামী  বাড়ির  রঘুনন্দন   সেবায়ত  দণ্ডির  নিকট  বেদান্তাদি  অধ্যায়ন  করতেন।  সেবায়ত  দণ্ডির  কাছে  সদ্য  সমাপ্ত  দুটি  কৃষ্ণ  মূর্তি  ছিল।   রঘুনন্দন  ফিরে  যাওয়ার  সময়  দুটি  বিগ্রহের  মধ্যে  একটি  প্রার্থনা  করেন।  দণ্ডি  চোখবাঁধা  অবস্থায়  একটি  নিতে  বলেন।  রঘুনন্দন  সেই  অবস্থায়  যেটি  নেন  সেটি  মধ্যম  গোস্বামী  বাড়ির  গোকুলচাঁদ  এবং  অপরটি  গুপ্তিপাড়া  মঠের  কৃষ্ণচন্দ্র  বিগ্রহ।  দুটি  বিগ্রহের  মধ্যে  খুবই  সাদৃশ  আছে। কালের নিয়মে ও উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার অধিকাংশ কাজই আজ লুপ্তপ্রায়। মুল মন্দিরের কার্নিশের নীচে, তিন খিলানের পার্শ্ববর্তী দেওয়ালে ও থামের উপর অবশিষ্ট সামান্য কিছু কারুকার্য গৌরবান্বিত অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে।  
 
কৃষ্ণচন্দ্রের  মন্দির
 

কৃষ্ণচন্দ্রের  মন্দিরের পেছনের দিক  |
 
 

মহাপ্রভু  বা  শ্রীচৈতন্যের  মন্দির

 কৃষ্ণচন্দ্রের  মন্দিরের  সামনের  রোয়াক  ধরে  উত্তর  দিকে  সামান্য  এগুলে  বাঁদিকে  পড়বে  মহাপ্রভুর  মন্দির।  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত  মহাপ্রভুর  জোড়বাংলা  মন্দিরটি  এখানকার  মন্দিরগুলির  মধ্যে  সবচেয়ে  পুরানো।  প্রতিষ্ঠাফলক  না  থাকায়  মন্দিরটি  কবে  তৈরী  তা  জানা  যায়  না।  তবে  ইঁটের  পাতলা  গড়ন  ও  স্থাপত্য  বৈশিষ্ট  দেখে  মন্দিরটি  সতের  শতকের  গোড়ার  দিকে  নির্মিত  বলে  অনুমান  করা  যায়।  মন্দিরে  শ্রীচৈতন্য  ও  নিত্যানন্দের  কাঠের  বিগ্রহ  অধিষ্ঠিত।  বর্তমানে  মন্দিরটি  পশ্চিমমুখী   হিসাবে  ব্যবহার  করা  হয় ।  কিন্তু  মন্দিরটি  প্রথমে  পূর্বমুখী  ছিল।  পূর্ব  দিকে  খিলান  প্রবেশপথ  ও  ইমারতি  থাম  আছে।  খিলান  প্রবেশপথের  ওপরে  পোড়ামাটির  কিছু  কাজ  এখনও  বর্তমান  আছে।  জানা  যায়,  এটি  প্রথমে  বৃন্দাবনচন্দ্রের  মন্দির  ছিল।  পরে  ইংরেজ  আমলের  গোড়ার  দিকে  বৃন্দাবনচন্দ্রের  মন্দির  তৈরী  হলে  মহাপ্রভুর  মূর্তি  এখানে  প্রতিষ্ঠিত  হয়।




মহাপ্রভু  বা  শ্রীচৈতন্যের  মন্দির |



 
  বৃন্দাবনচন্দ্রের  মন্দির

কৃষ্ণচন্দ্রের  মন্দিরের  সামনের   উত্তর  দিকে  সামান্য  এগিয়ে  ডান  দিকে  ঘুরলে  পড়বে  বৃন্দাবনচন্দ্রের  মন্দির।  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  ত্রিখিলানবিশিষ্ট,  অলিন্দযুক্ত,  দক্ষিণমুখী,  বাংলা  আটচালা  শ্রেণীর  বৃহৎ  মন্দির।  সামনের  দিকে  তিনটি  প্রবেশদ্বার।

মন্দিরের  ত্রিখিলান  বিন্যাস

  অলিন্দের  সামনে  একটি  বড়,  দুপাশে  দুটি  ছোট-ছোট।  পশ্চিম  দিকে  আর  একটি  প্রবেশদ্বার  আছে।  পূর্ব  দিকের  প্রবেশ  দ্বারটি  ভরাট  করা।  মন্দিরটিতে  টেরাকোটার  কাজ  খুব  বেশি  নেই।  খিলানগুলির  উপরের  চারিদিকে  বাংলা  চারচালা  শ্রেণীর  প্রতীক  শিবালয়  ও  তারমধ্যে  শিবলিঙ্গ।  উপরের  কার্নিসের  নিচে  দুই  প্রস্থে  পোড়ামাটির  ফুল  এবং  দু  পাশের  উপরে-নিচেও  একই  রকমের  ফুল  মন্দিরটির  অঙ্গসজ্জা  রূপে  রয়েছে।  ইমারতি  থামে  কিছু  পোড়ামাটির  মূর্তি  ইত্যাদি  আছে।  বাঁকানো  কার্নিসের  নিচেও  পোড়ামাটির  কাজ  আছে। 



  বৃন্দাবনচন্দ্রের  মন্দির

            এই  মন্দিরের  উল্লেখযোগ্য  বৈশিষ্ট  হল,  এর  ঢাকা  বারান্দা  ও  গর্ভগৃহের   দেওয়ালে  রয়েছে  সুন্দর-সুন্দর  ফ্রেসকো  পেন্টিং।  বিষয়বস্তু  পৌরাণিক  কাহিনী,  ফুল ইত্যাদি।  গর্ভগৃহে  শ্রী শ্রী  বৃন্দাবনচন্দ্র,  রাধিকা,  গরুড়  এবং  পিছনের  উঁচু  বেদিতে  জগন্নাথ,  বলরাম  ও  সুভদ্রার  বিগ্রহ  নিত্য  পূজিত  হন।  সত্যদেব  সরস্বতী  শান্তিপুরের  এক  গৃহস্থের  বাড়ি  থেকে  শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রকে  এনে  এখানে  প্রতিষ্ঠা  করেন ।  তাঁহার  শিষ্য  রাজা  বিশ্বেশ্বর  রায়  বৃন্দাবনচন্দ্রের  সেবার  জন্য  গুপ্তিপাড়ার  দক্ষিণে  সোমড়া  গ্রাম  দেবোত্তর  হিসাবে  দান  করেন।  রথযাত্রার  সময়  জগন্নাথ,  বলরাম  ও  সুভদ্রার  বিগ্রহ  এক  অত্যুচ্চ  রথে  বসিয়ে  টানা  হয়।  জগন্নাথ  দেবের  রথযাত্রা  গুপ্তিপাড়ার  অন্যতম  আকর্ষণ।  মাহেশ  ছাড়া  এত  বড়  রথ  পশ্চিমবঙ্গের  আর  কোথাও  নেই।  এই  উপলক্ষ্যে  এখানে  বড়  মেলা  বসে।  উল্টোরথের  আগের  দিন  মাসির  বাড়িতে  জগন্নাথদেবের   মাসির  বাড়ি  এই  মন্দিরের  অল্প  দুরে  বড়বাজারে  অবস্থিত   দেবতার  ভোগ  ঠাকুরকে  নিবেদন  করার  পর  পুরোহিত  মন্দিরের  দরজা  খুলে  দেন  এবং  জনসাধারণ  সেই   প্রসাদ  লুট  করে।  একে  'ভান্ডার  লুট'  বলে।


মন্দিরের  একটি  ইমারতি  থাম


রামচন্দ্রের  মন্দির

গুপ্তিপাড়ার  উল্লেখযোগ্য  দ্রষ্টব্য  শ্রীরামচন্দ্রের  মন্দির।  বাঁশবেড়িয়ার  অনন্ত বাসুদেব  মন্দিরের  মত  এর  গড়ন।  এরূপ  কারুকার্যখচিত  মন্দির  পশ্চিমবঙ্গে  খুব  কমই  আছে।  এর  টেরাকোটার  কাজ  খুবই  উচ্চ  শ্রেণীর।  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত, পশ্চিমমুখী,  ইঁটের  তৈরী  মন্দিরটি  বাংলা  একরত্ন  শ্রেণীর।  মন্দিরের  শিখর-রত্নটি  আটকোণা। 

রামচন্দ্রের  মন্দির

মন্দিরের   সামনে  তিনটি  পত্রাকৃতি  খিলান  যুক্ত  আবৃত  অলিন্দ  আছে।  সামনের  ত্রিখিলান  প্রবেশপথের  ওপরের  তিনপ্রস্থে,  থাম  ও  ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  দেওয়ালে  এবং  শিখরে  প্রচুর উৎকৃষ্ট  টেরাকোটা  আছে। টেরাকোটায়   রাধাশ্যামের  মূর্তি,  গরুড়বাহন  বিষ্ণু,  রাবণের  যুদ্ধযাত্রা  প্রভৃতি  সুন্দর  ভাবে  ফুটে  উঠেছে।  একটি  খিলানের   উপর  প্রার্থনার  ভঙ্গিতে  যুক্ত  শত  শত  গোপিনী  মূর্তি  পোড়ামাটির  অলংকরণের  একটি  সুন্দর  নিদর্শন।  প্রবেশ  পথের  দু  পাশে  তিন  সারিতে  ও  উপরে  দু  সারিতে  নিবদ্ধ  নকশা  করা  ফ্রেমের  মধ্যে  রাধা-কৃষ্ণ  ও  নরনারীর  নানা  ভঙ্গিমার  চিত্র  ফুটে  উঠেছে।  এরূপ  সুক্ষ্ম  ও  ছন্দময়  কারুকার্য  হুগলি  জেলার  কোন  মন্দিরে  নেই।  তবে  এর   বেশির  ভাগ  মূর্তিই  নষ্ট  হয়ে  গেছে।  থামের  উপরের  দিকের  ও  অলিন্দের  মধ্যের  টেরাকোটাগুলি  কলিচুনের  প্রলেপে  নষ্ট  বা  ম্লান  হয়ে  গেছে।  দক্ষিণ  দিকের  দেওয়ালেও  প্রচুর  টেরাকোটার  কাজ  আছে।  তবে  এখানে  তিনটি  খিলান  ছাড়া  অন্যত্র  টেরাকোটার  ফুলের  আধিক্যই   বেশি।  রামচন্দ্রের  মন্দির  পোড়ামাটির  সজ্জার  জন্য  বাংলার  অন্যতম  টেরাকোটা  মন্দির  বলে  পরিগণিত।  মন্দিরের  সামনের  দিকে  তিনটি  প্রবেশদ্বার।  সোজাসুজি  একটি  বড়,  দুপাশে  দুটি  ছোট-ছোট।  উত্তর  ও  দক্ষিণ  দিকে  একটা  করে  জানলা  আছে।  পূর্ব  দিকে  কোন  জানলা  বা  দরজা  নেই।  গর্ভগৃহে  রামচন্দ্র,  সীতা,  লক্ষ্মণ  ও  হনুমানের  দারু  মূর্তি  প্রতিষ্ঠিত।  অষ্টাদশ  শতকের  শেষের  দিকে  শেওড়াফুলির  রাজা  হরিশচন্দ্র  রায়  মন্দিরটি  প্রতিষ্ঠা  করেন।



আটকোণা  শিখর-রত্ন

 


 টেরাকোটার  অলংকরণ



 টেরাকোটার  অলংকরণ

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم